আমেরিকান বিজনেস স্কুলে –
§ এডমিশনই পাওয়া যায়না।
§ জিম্যাট ছাড়া ওরা কথা বলেনা
§ ফান্ড পাওয়া ইম্পসিবল
এইগুলো খুব কমন, কিন্তু বাজে কথা।
আমি এই ফল ২০১৭ থেকে fully funded মাস্টার্স (MS in Economics and Finance) শুরু করেছি Southern Illinois University Edwardsville (SIUE) তে । এবার আমার গল্প বলি। এই গল্প হয়ত অনেককেই সাহস যোগাবে উচ্চশিক্ষার পথে আরো একধাপ এগিয়ে যেতে।
আমেরিকাতে আসার কোন চিন্তাই ছিলনা। Bangladesh Institute of Bank Management (BIBM) এ ৫ম সেমিস্টারে পড়ছি, পড়ালেখার পাটচুকিয়ে কোন এক ব্যাংকে ঢুকে সুখে শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দেবো। কিন্তু বাগড়া বাজাল আমার জীবনসঙ্গী। হঠাৎ করে ফল ২০১৬ তে PhD fund নিয়ে পাড়ি দিল আমেরিকায়। ওর আশা আমিও পাড়ি দিবো ওর কাছে। আমি যেতে রাজি, তবে ঘরে বসে থাকতে রাজি না। ওর ও তাই ইচ্ছা। একটাই উপায় F1 ভিসা নিয়ে আমেরিকায় যেতে হবে।
শুরু হল আমাদের নতুন যুদ্ধ, ফান্ড লাগবে। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড বিজনেস স্টাডিস, তার উপর দ্বিতীয় মাস্টার্স। আগের রেকর্ড বলে ফান্ড পাওয়া অনেক কঠিন, কিন্তু অসম্ভব না। ঠিক করলাম এপ্লাই করব Economics, Finance অন্যথায় MBA এর জন্য।
জিম্যাট নাকি জিআরই – কোনটা পড়ব? অনেক বিজনেস স্কুলের ওয়েবসাইট ঘেটে দেখলাম, হাতেগোনা দুয়েকটা ছাড়া, সবাই এই দু’টো এক্সামকেই এক্সেপ্ট করে। আমার হাজব্যান্ড GRE পরীক্ষা দিয়েছিল, তাই GRE সম্পর্কে আগে থেকে আইডিয়া ছিল। GRE পরীক্ষাই দিব সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সেপ্টেম্বর থেকে GRE প্রস্তুতি শুরু – জানুয়ারিতে GRE, TOEFL দেওয়ার ইচ্ছা। এই টাইমলাইন নিয়ে পরবর্তী ফল ধরা খুবই কঠিন। তখন আবার আমার ইন্টার্নশীপ শুরু করেছি ব্যাংকে – ১০টা – ৬টা অফিসও করতে হয়। GRE ব্যাপারে অনেক সাহায্য পেয়েছি এই গ্রুপ থেকে। তাই GRE প্রস্তুতি নিয়ে কিছু লিখছিনা – সব প্লান এই গ্রুপের ডক সেকশনে আছে।
আমি GRE পড়ি, আর আমার জামাইবাবু ভার্সিটি লিস্ট করে। ভার্সিটি সিলেক্ট করা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। HSA acceptance list দেখে বিজনেস স্কুলে কে কে এক্সেপ্টেড হয়েছে, কোন বিজনেস স্কুলে, স্কোর কেমন লাগে – এরকম ইনফো আমরা লিস্ট করলাম। মোটামুটি ১০ টা ইউনিভার্সিটি পাওয়া গেল যেখানে বাংলাদেশী স্টুডেন্টরা ফান্ডিং নিয়ে পড়তে গেছে। তারমানে বোঝা গেল বিজনেস স্কুলে ফান্ডিং পাওয়ার আশা আছে।
ইউনিভার্সিটি সিলেকশনের পাশাপাশি হাত দেই SOP লেখাতে। আমার মতে SOP লেখা সবচাইতে কঠিন কাজ। আমি SOP লিখি, আর আমার হাজব্যান্ড এডিট করে। কিন্তু কিছুই হয়না। আমি লিখতে লিখতে কাঁদি, উনি ধমক লাগায়। যাইহোক, অনেক কষ্ট করে, অনেক জনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে লিখলাম SOP। আগেই বলেছি SOP লেখা সবচেয়ে কঠিন কাজ, এটা লেখাতে অনেক সময় দিতে হবে। SOP লেখার কোন শর্টকাট নাই, কোন ফর্মুলা নাই। এই গ্রুপের ডকে অনেকেই SOP শেয়ার করেছেন। এইগুলো থেকে আইডিয়া নেয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রত্যেকের থাকবে নিজস্ব গল্প।
আবার TOEFL ও দিতে হবে। কিন্তু তখনি TOEFL রেজিস্ট্রেশন করিনি। যদি GRE স্কোর ভাল আসে, তবেই TOEFL পরীক্ষা দিব -অন্যথায় সব পয়সা জলে যাবে । আলহামদুলিল্লাহ, GRE স্কোর এল ৩০৯, সাথে সাথে TOEFL রেজিস্ট্রেসন করতে বসলাম। কিন্তু বিধিবাম, পরবর্তী এভেইলেবল ডেট মাত্র ৫ দিন পরে, এরপরেরটা ২৫ দিন!! উপায় নাই ৫ দিন পরের ডেটই নিতে হবে। TOEFL score খারাপ হল, মাত্র ৯৩, কিন্তু আর সময় নাই, ট্রাই করতে দোষ কি।
এরপর শুরু হল Graduate Coordinator এর সাথে যোগাযোগ করা। ১০টা ইউনিভার্সিটিতে ইমেইল করলাম, আমার প্রোফাইল জানিয়ে।
§ BBA in AIS, CGPA 3.83, UIU
§ MBM, CGPA 3.50, BIBM
§ GRE 309, TOEFL 93
§ No job experiences, No publication
৫ জন জানাল আমার প্রোফাইল নিয়ে ফান্ড পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আল্লাহর নাম এ শুরু করলাম এপ্লিকেশন করা।
এরপর শুর হল অপেক্ষার পালা। এরমাঝে আবার ব্যাক আপ হিসেবে F2 ভিসার এর জন্য আবেদন করলাম, ভিসা পেয়েও গেলাম।
University of Cincinnati থেকে স্কাইপ ইন্টারভিউ নিল। যৎসামান্য ফান্ডিং ও অফার করল। কিন্তু ভিসার জন্য অনেক টাকা দেখাতে হবে। এত টাকা দেখালে আমেরিকান এম্বেসি আর আমাকে ভিসা দিবেনা। তাই এই অফারটা ডিক্লাইন করলাম।
এরপর আবার অপেক্ষা করি আর বাকি কারো কোন খবর নাই। মাঝে মাঝে গ্র্যাড কো-অর্ডিনেটরদের ইমেল করি- কেউ রিপ্লাই দেয় আবার কেউ দেয়না। একদিন SIUE এর কো-অর্ডিনেটর জানালেন Graduate Scholar Award (GSA) নামে একটা scholarship আছে যা ফুল টিউশন ওয়েভ করে। মনে হল ভাল জিনিস, এপ্লাই করলাম ।
এরপর আবার অপেক্ষা করি। দুএকটা ভার্সিটি থেকে এডমিশন দিল, কিন্তু ফান্ড নাই। অবশেষে, মে মাসের শেষের দিকে SIUE থেকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল আমি GSA স্কলারশিপ পেয়েছি MS in Economics & Finance। কিন্তু এই স্কলারশীপ শুধু টিউশন কাভার করবে, থাকা-খাওয়া নিজের । খবর নিয়ে দেখলাম, থাকা-খাওয়ার খরচ অন ক্যাম্পাস জব করে চালানো যাবে। তাই আল্লাহর নামে এক্সেপ্ট করলাম এই অফার ।
SIUE I-20 পাঠাবে কিন্তু তাদেরকে আমার ফাইনান্সিয়াল পেপার্স দেখাতে হবে যে, ডেফিসিট $18000, ব্যাংকে ছয় মাস ধরে থাকতে হবে। এই ব্যাপারে প্রস্তুতিটা একটু আগে ভাগেই নিয়েছিলাম। GRE দেবার পরপরই (জানুয়ারি মাসে) ব্যাংক লোন নিয়ে বাবাকে দিয়ে ১০ লক্ষ টাকার একটা FDR করিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা যে FDR টা করেছে ওটাতে এখনো ৬ মাস হয়নি। তার মানে বাবাকে স্পন্সর হিসেবে দেখানো যাবেনা। তখন HSA তে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম, I-20 আনার জন্য স্পন্সর মোটামুটি যে কাউকে দেখানো যায়। ব্যাংকের কাগজপত্র ঠিক থাকলেই ইউনিভার্সিটি I-20 পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ভিসা আবেদনের সময় এই স্পন্সরিং ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতপর, আমার ছোটখালা আর নানুমণিকে স্পন্সর দেখিয়ে নিয়ে এলাম I-20। ভাগ্যিস, I-20 তে লেখা ছিল Family Fund।
এবার এম্বেসিতে দাঁড়ানোর পালা। ভিসা ইন্টারভিউ এর বিশাল কিউ, ডেট পেলাম ১৬ জুলাই, ততদিনে বাবার FDR টাও ৬ মাস মেয়াদি হয়ে গেছে। কিন্তু, HSA তে সবাই পোস্ট দিচ্ছে পার্শিয়াল ফান্ড মানেই ভিসা রিজেক্ট। ভয়ে ভয়ে F1 ভিসার জন্য আবেদন করলাম। ভয় হচ্ছিল F1 না দিয়ে যদি আবার F2 ও রিজেক্ট করে দেয়। আমি প্রস্তুত ছিলাম কিছু প্রশ্নের জন্য,
§ Why Second Master’s?
§ Why didn’t you enter USA earlier with F2 VISA?
§ Who is going to sponsor $18000? How?
ভিসা ইন্টারভিউয়ে প্রথম দুই টপিক নিয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করলনা, শুধু জানতে চাইল বাকি টাকা কিভাবে পে করব। বাবা স্পন্সর দেখে আমাকে খুব বেশি বেগ পোহাতে হয়নি। ৬৬% স্পন্সর দেখিয়েও ভিসা এপ্রুভ করে দিল। আমার খুশি আর দেখে কে!
Related Post: Click
এরপর SIUE Bangladesh Student Association এর সাথে যোগাযোগ করি। ওনারা অনেক সাহায্য করে – বাসা ঠিক করে দেয়, অন ক্যাম্পাস জব কিভাবে পাওয়া যাবে সেটার প্রসেস বলে দেয়। এর মাঝে আবার, গ্র্যাজুয়েট কো-অর্ডিনেটর জানাই যে আমি ভিসা পেয়েছি, আমি এই মাস্টার্স প্রোগ্রামে জয়েন করছি। আবার ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের কাছে কোন ধরনের এসিস্ট্যান্টশিপ কি বাকি আছে(!!) – আমার খুব দরকার।
২৯ জুলাই চলে এলাম আমেরিকায়। SIUE তে গেলাম, এডমিশান, কোর্স রেজিস্ট্রেশন, ওরিয়েন্টেশন হল। ওরিয়েন্টেশন শেষে ক্যাম্পাস ডাইনিং সার্ভিসে একটা পার্ট-টাইম চাকুরিও যোগাড় করে ফেললাম। যে টাকা দিবে ওতে আমার থাকা-খাওয়া টেনেটুনে হয়ে যাবে। এবার গেলাম ডিপার্টমেন্টে ঢুঁ মারতে। গ্র্যাজুয়েট কো-অর্ডিনেটরকে নিজের পরিচয় দিতেই সে নড়েচড়ে উঠে আমাকে বলল – তোমাকেই তো খুঁজছি আমরা, তোমাকে ইমেইল করেছি, কিন্তু রিপ্লাই করছনা কেন। আমি তো হত-বিহবল – মানে কি? সারাদিন দৌঁড়ের উপর আছি, ইমেইল দেখার সময় কোথায় পেলাম। এবার সে বিস্তারিত বলা শুরু করল – তোমাকে আমরা গ্রাজুয়েট এসিস্ট্যান্টশিপ অফার করছি, তুমি কি এক্সেপ্ট করবে? আমি বললাম কেন করবনা – আমিতো খুশিতে আত্মহারা।
আমি মাস্টার্স করি ইলিনয়ে, আর আমার হাজব্যান্ড পিএইডি করে কেন্টাকিতে – চার ঘন্টা ড্রাইভে আমাদের সংসার। দু’আ করবেন আমাদের জন্য। HSA, NexTop USA এর কাছে আমরা অশেষ কৃতজ্ঞ।
Post Credit:
Tazin Poushi & Parag Jafar Siddique