আমি ওই ছেলেটাকে কোন উত্তর দেইনি। প্রশ্নই আসে না উত্তর দেয়ার

কুষ্টিয়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র আমাকে একটা ই-মেইল করেছে। পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে বলার আগে বরং মেইলে সে কি লিখেছে; সেটা বলা যাক। মেইলটি সে ইংরেজিতে লিখেছে। এর বাংলা করলে যা দাঁড়ায়-

স্যার,

আমি কুষ্টিয়ার ইসলামিক ইউনিভার্সিটির সমাজকর্ম বিভাগের তৃতীয়বর্ষের ছাত্র। আমার খুব ইচ্ছা আমি বিদেশে পড়তে যাবো। আমার রেজাল্ট অনেক ভালো। আমার স্থান ক্লাসে সেকেন্ড। তবে আমার পারিবারিক অবস্থা অতটা ভালো না। আমার স্কলারশিপ এবং পার্টটাইম জবও লাগবে। আমি আপনার ইউনিভার্সিটি কিংবা অন্য যে কোন ইউনিভার্সিটিতে বিদেশে পড়তে যেতে চাই। আমার কি আই-ই-এলটিএস লাগবে?

তো, এই পুরো মেইলটি সে লিখেছে সাবজেক্ট বক্সে! ইউনিভার্সিটি’তে পড়ুয়া একটা ছেলে বিদেশি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে মেইল করেছে। সেখানে মূল মেইল বক্সে কিছুই লেখা নেই! একদম ফাঁকা! আর সাবজেক্ট বক্সে এইসব লিখে রেখেছে!

এই মেইলটি এসছে গত পরশু। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই নিয়ে কিছু লিখব। লেখার একদম সময় পাচ্ছিলাম না। আজ খানিক সময় পেয়েছি। তাই ভাবলাম লিখে ফেলা যাক।

আমার এখানে সামার ভ্যাকেশন চলছে। প্রায় আড়াই মাসের ছুটি শেষ হতে চলেছে। সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ থেকে আবার ক্লাস, সেমিনার, কনফারেন্স, থিসিস সুপারভিশন শুরু। তো, এই আড়াই মাস ছুটিতে আমি কি কি করেছি?

সাধারণত প্রতি সামারই কোন না কোন দেশে ঘুরতে যাই আমি। গত দুই সামারে যাওয়া হচ্ছে না। এই সামারেও কোথাও যাইনি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- কিছু একটা শিখবো। গত ১৮ বছর ধরেই প্রতি সামারে আমি নতুন কিছু না কিছু শিখছি। চাকরি করে সামার মানে গ্রীষ্মের ছুটি ছাড়া আর অন্য কোন সময়ে খুব একটা সুযোগ পাওয়া যায় না।

আমার মনে আছে এক সামারে মনে হলো গীটারটা ভালো করে শিখে ফেলা যাক। শিখেও ফেললাম। আরেক সামারে মনে হলো একটা নতুন ভাষা শিখে ফেললে কেমন হয়? শিখেও ফেললাম এস্তনিয়ান ভাষা। শুধু শিখিইনি। পরীক্ষা দিয়ে একশোতে সর্বোচ্চ ৯১ নাম্বার পেয়ে পাশও করেছি। এভাবে অন্যান্য সামারে আরও কিছু ভাষাও আমি শিখেছি। হারমনিকা বাজানো শিখেছি। আরেক সামারে তো সালসা ড্যান্সের পুরো কোর্স শেষ করে ফেলেছি।

এই সামারেও নতুন একটা বিষয় শিখছি। যেহেতু এখনও শেখা শেষ হয়নি। তাই এই নিয়ে আজ বলছি না। এই শেখার বাইরেও আমার মনে হয়েছে- আমার হাতে সময় আছে। আমি আমার ইংরেজি বই লেখাটা শেষ করেছি। এরপরও মনে হলো হাতে সময় আছে। একটা আস্ত বাংলা বইও লেখা শেষ করেছি। শুধু শেষ’ই করিনি। প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েও দিয়েছি। আশা করছি দ্রুতই প্রকাশ হবে। এই যে আপনারা আমাকে ফেসবুকে লিখতে দেখতেন কিংবা আপনাদের কমেন্টের উত্তর দিতে দেখেন। আমি আমার ফেসবুকে সময় দেই তখনই; যখন আমার হাতে ফ্রি সময় থাকে। অর্থাৎ আমি আমার ফ্রি সময় টুকুও কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। নইলে সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আমি কাজ’ই করি।

এখন আপনারা হয়ত ভাবতে পারেন, আমি আমার কথা কেন লিখছি। আমি তো আর এমন কেউ নই। অতি অবশ্যই আমি এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নই। কোন সফল মানুষও নই। তবে এই উদাহরণটা দেয়ার একটা কারন আছে। লেখার শেষে আমি এটি ব্যাখ্যা করব। নিজেকে জাহির করা আমার উদ্দেশ্য নয়।আমার মনে আছে আজ থেকে ২৫ বছর আগে আমি যখন সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম- আমার নিজের একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার ছিল। যেহেতু আমার বাসা ঢাকায়। ছুটি-ছাটার সময় সিলেট থেকে সিপিইউটা সাথে করে নিয়ে আসতাম ঢাকায়। আমাদের ঢাকার বাসাতে আলাদা একটা মনিটর ছিল। ছুটির সময় আমি কম্পিউটারের নানান সব বিষয় নিজে নিজে শেখার চেষ্টা করলাম।আজ থেকে ২০-২২ বছর আগেই তো আমি জানতাম কিভাবে ই-মেইল লিখতে হয়। তাহলে এই যুগে এসে, যেখানে সবার হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। ইন্টারনেট সবার হাতের নাগালে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়বর্ষের একজন ছাত্র, যে নিজেকে ক্লাসে সেকেন্ড দাবী করছে! সে কিনা একটা ই-মেইল লিখছে সাবজেক্ট বক্সে!শুধু তা-ই না। একটা ইংরেজি মেইল লিখেছে; এর মাঝে হাজারটা ভুল! আমি এখানে তিনটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। একটায় ফুল টাইম। বাদ বাকী দু’টোয় পয়েন্ট ২৫ বেসিসে পড়াই। আমার কাছে প্রতিদিন পৃথিবীর নানান দেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা মাস্টার্স-পিএইচডি করার জন্য মেইল করে। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়।এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আমি কী সব মেইল পুরোটা পড়ি? হ্যাঁ, আমি সব মেইলই খুলে দেখি। কিন্তু প্রথম দুই-তিন লাইন পড়ে যদি আমার ভালো না লাগে; তাহলে আমি আর পড়ি না।আমি এই জানুয়ারিতে দেশে গিয়েছিলাম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলজের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষকদের গবেষণা পদ্ধতি বিষয়ক একটা ট্রেনিং কোর্সে পড়িয়েছি। দেখলাম প্রায় সকল শিক্ষক বিদেশে পড়তে আসতে চায়।আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি গেস্ট লেকচারার হিসেবে। ওখানকার ছাত্ররাও প্রায় সবাই বিদেশে পড়তে আসতে চায়।আমার ধারণা বাংলাদেশের ছাত্র-শিক্ষকদের একটা বিশাল অংশ এখন বিদেশে পড়তে আসতে চায়। কারন তারা হয়ত বিদেশেই সেটেল হতে চায়। এটা যার যার ব্যাপার। আমার এতে কোন আপত্তি নেই।তো, বিদেশে পড়তে আসতে হলো নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। সেটা আপনি যেই দেশেই পড়তে যান। আমি বরং খুব ছোট করে দুই একটা টিপস দেই।প্রথম কাজ হচ্ছে- ইংরেজিতে অতি অবশ্যই ভালো হতে হবে। আপনাকে যদি ইংরেজিতেই পড়াশুনা করতে হয়; তাহলে ইংরেজি না জানলে কিভাবে পড়বেন? আপনাকে ইংরেজদের মত ইংরেজি বলতে হবে না। স্রেফ ইংরেজিতে পড়ার মত যোগ্যতা থাকতে হবে। এর মানে হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই ইংরেজির চর্চা করতে হবে। শিখতে হবে। যাতে করে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে আই-ই-এলটিএস পরীক্ষা দিয়ে অন্তত ছয় কিংবা সাড়ে ছয় পাওয়া যায়। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সাধারণত এমনই চায়। তবে নামি-দাবী বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এর চাইতে বেশিও চাইতে পারে। এই যেমন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার সময় আমাদের লেগেছিল মিনিমাম সাড়ে সাত পয়েন্ট।যা হোক, মূল বিষয় হচ্ছে ইংরেজি জানতে হবে।

দ্বিতীয় বিষয়ঃ কিভাবে ই-মেইল করতে হয় সেটি অতি অবশ্যই শিখতে হবে। শুধু সেটাই না। কিভাবে প্রথম তিন-চার লাইনেই একজন অধ্যাপক কিংবা যে কাউকে ইম্প্রেস করা যায়; সেটিও শিখতে হবে।

তৃতীয় বিষয়ঃ যখনই সময় পাওয়া যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইট নিজেকেই ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে হবে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর রিকয়ারমেন্ট গুলো জানা যাবে। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুতও করা যাবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ইংরেজি কিভাবে শিখবেন? কিংবা ই-মেইল করা কিভাবে শিখবো?

এই জন্যই আসলে আমি আমার নিজের কাজের বিবরণ দিয়েছি। আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা দিনভর ফেসবুক করে। ইউটিউব দেখে। এরপর সর্বক্ষণ পরচর্চা করে বেড়ায়। এইসব না করে- যখনই সময় পাওয়া যাবে ইউটিউব দেখে কিংবা বই পড়ে ইংরেজি শিখে ফেলার চেষ্টা করতে হবে। একই ভাবে কিভাবে ই-মেইল লেখা যায়। কিভাবে মোটিভেশন লেটার লেখা যায়; এইসবও শেখা সম্ভব।

আমাদের সময়ে ইন্টারনেট সব জায়গায় ছিল না। আমি আজ থেকে ২২ বছর আগের কথা বলছি। আমরা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেট চালাতাম। এরপরও ইচ্ছা থাকায় শিখতে পেরেছে। আর এখন তো এইসব শেখার জন্য কোথাও যাবার দরকার নেই। একটা পয়সাও খরচ করার দরকার নেই। প্রত্যন্ত গ্রামের বাসায় বসেও স্রেফ নিজের মোবাইল টিপে ইউটিউব দেখেই শিখে নেয়া সম্ভব। বই পড়তে মন না চাইলেও সমস্যা নেই।

আমি ওই ছেলেটাকে কোন উত্তর দেইনি। প্রশ্নই আসে না উত্তর দেয়ার। আমার মনে হয়েছে বরং আস্ত একটা লেখা লিখি সবার জন্য। মূল বিষয় হচ্ছে সময় টুকু কাজে লাগাতে হবে। আমরা বাংলাদেশিরা জীবনের একটা বিশাল অংশ শুয়ে-বসে কিংবা কোন কিছু না করেই কাটিয়ে দেই। আপনার যদি কোন কাজ না থাকে। তাহলেও আপনি ঘরে বসে কিছু একটা শিখে ফেলতে পারেন। জীবনের কোন না কোন সময় এটি কাজে দিবে। জেনে রাখুন- আপনার ভাগ্য আপনাকেই তৈরি করতে হবে। কেউ এসে তৈরি করে দেবে না। এই ছেলেটা যদি চমৎকার করে একটা মেইল লিখত। কে জানে; আমি হয়ত তাকে উত্তর দিতাম।

©️

আমিনুল ইসলাম স্যার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *